খুলনা মহানগরী জামায়াতের সিরাতুন্নবী (সা.) সেমিনার
নিখিল বিশ্ব রাসুল (সা.) আদর্শের দিকে যত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে
পারবে, ততো তাড়াতাড়ি যুগের সকল সংকট চিরতরে দূরীভূত হবে
---মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও খুলনা অঞ্চলের পরিচালক মুহাদ্দিস আব্দুল খালেক বলেন, সমগ্র পৃথিবীটাই হাজার সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। সকল সংকট থেকে উত্তরণের পথ বা পন্থা রয়েছে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায়। আর জীবন্ত ইসলামী জীবন ব্যবস্থাই হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সা,) এঁর কলোত্তীর্ণ আদর্শ। আরবের নিকষ অন্ধকারাচ্ছন্ন জাহিলীয়্যাতকে আলোকোজ্বল ঝলমলে নান্দনিকতায় রূপান্তর করতে সফল ভূমিকা রেখে ছিল, বিংশ শতাব্দীর এই জাহিলীয়্যাত মুছে ফেলতেও তাঁর কোন বিকল্প নেই। তাঁর আদর্শের মধ্যেই মূলত আধুনিক বিশ্বে উদ্ভূত সমস্ত সংকট থেকে উত্তরণের মন্ত্র নিহিত রয়েছে। নিখিল বিশ্ব তাঁর আদর্শের দিকে যত তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে পারবে, ততো তাড়াতাড়ি যুগের সকল সংকট চিরতরে দূরীভূত হবে।
জুময়াবার (২০ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় খুলনা মহানগরী জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে খুলনা প্রেসক্লাবের লিয়াকত আলী মিলনায়তনে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্মানে ‘আধুনিক বিশে^র সংকট উত্তরণে বিশ^নবী (সা.) এঁর আদর্শ’ শীর্ষক সিরাতুন্নবী (সা.) সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ও খুলনা মহানগরী আমীর অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের সভাতিত্বে ও সেক্রেটারি এডভোকেট শেখ জাহাঙ্গীর হোসাইন হেলালের পরিচালনায় প্রধান বক্তা ছিলেন মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নির্বাহী পরিচালক প্রফেসর ড. মঞ্জুর মাহমুদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় কর্মপরিষ সদস্য ও খুলনা অঞ্চলের সহকারী পরিচালক। সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপত্থাপন করেন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয় কুস্টিয়ার দাওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর ড. আ ছ ম তরীকুল ইসলাম। এ সময় খুলনা মহানগরী নায়েবে আমীর অধ্যাপক নজিবুর রহমান, মহানগরী সহকারী সেক্রেটারি এডভোকেট শাহ আলম ও প্রিন্সিপাল শেখ জাহাঙ্গীর আলম, জেলা সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক মিয়া গোলাম কুদ্দুস, মহানগরী ছাত্রশিবির সভাপতি আরাফাত হোসেন মিলন ও সেক্রেটারি মোহাম্মদ নূরুল্লাহ, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের মহানগরী সভাপতি আজিজুল ইসলাম ফারাজী ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মাহফুজুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বজুড়ে বর্তমানে যে সংকট বিরাজমান তা থেকে উত্তরনের একমাত্র পথই হচ্ছে মহানবীর(সা.) আদর্শ বাস্তবায়ন। কেননা মহান আল্লাহ মহানবীকে(সা.) সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। যার ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহ পবিত্র কুরআনেই ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয়ই তোমাদের জন্য রাসুলের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’ এমনকি যার আদর্শ উদ্ভূত সংকট নিষ্পত্তি করতে পারেনা, সে কোনভাবেই কারো কাছে সত্যিকারের অনুকরণীয় ও মনের মতো আদর্শ হতে পারে না বলেও প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়। সুতরাং একমাত্র পবিত্র কুরআন হচ্ছে তাত্ত্বিক ইসলাম আর মহানবী(সা.) হচ্ছেন জীবন্ত ইসলাম বা ইসলামের বাস্তব রূপ।
মহানবীর(সা.) আদর্শ থেকে দূরে থাকার কারণেই আজ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন সংকট বিরাজমান উল্লেখ করে প্রবন্ধে বলা হয়, যারা তাঁর আদর্শ থেকে যত বেশি দূরে নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তাঁরা ততো বেশি সংকটে আকণ্ঠ ডুবতে বাধ্য হয়েছে।
শিরক ও বিদ’আতের মাধ্যমে তৈরি হওয়া সংকট থেকেও রক্ষা করতে পারে একমাত্র রাসুল(সা.) এর আদর্শ এমনটিও উল্লেখ করা হয় প্রবন্ধে। বলা হয়, যারা ইকামতের দ্বীনের চেয়ে আকিদা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন তাতে তাদেরকে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্টদের পক্ষের দালাল বলেও মনে হয়। অর্থাৎ আকিদাকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে তাদের কাছে ইকামতে দীনের কাজ মূল্যহীন মনে হচ্ছে। এমনকি তারা ইকামতে দীনের মনগড়া ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সাধারণ জিহাদ তো বটেই এমনকি ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের জিহাদও তাদের কাছে জিহাদ বলে স্বীকৃতি পায় না। রাজতন্ত্রের দালালী তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
অতি উৎসাহী কিছু লোককে ইসলামের শত্রুরা তাদের হাতের ক্রীড়নক বানিয়ে শুধু ‘আকীদাহ নিয়ে ব্যস্ত রেখে ইসলামকে ধ্বংস করার সুযোগ নিচ্ছে কি না, তা আজ খুঁটিয়ে দেখার সময় এসেছে বলেও প্রবন্ধেউল্লেখ করা হয়।
বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকটের কথা তুলে ধরে প্রবন্ধেবলা হয়, অভাবে লাখ লাখ মানুষ অনাহারে থাকতে বাধ্য হওয়া বিশ্বের জন্য একটি বড় সংকট। অভিশপ্ত সুদভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা এই দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ। মহানবী(সা.) সুদভিত্তিক অর্থনীতির ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তাদেরকে সাবধান করেছেন। এ থেকে বিরত থাকার দিক নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি তিনি অলসতা দূর করে দারিদ্র্যমুক্ত হওয়ার জন্য মানুষকে কর্মী হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।
যাকাত ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থা দারিদ্র্য সংকট বিমোচনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা উল্লেখ করে প্রবন্ধেবলা হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্ল্হাু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম এ সম্পর্কে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘যে মালের যাকাত দেয় না, কিয়ামতে তার সম্পদ বিষাক্ত সাপে রূপান্তর করা হবে, যা তার গলদেশকে পেঁচিয়ে থাকবে।’ সুতরাং মহানবীর(সা.) যাকাত নীতি অনুসৃত হলে মাত্র ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে দরিদ্রতার সংকট উত্তরণ করা সম্ভব বলেও প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
বলা হয়, পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বা সমাজতন্ত্রী অর্থব্যবস্থা, উভয়ই যে অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণ করতে ব্যর্থ, আজ তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট। তবে রাসূলুল্লাহ(সা.)-এর অর্থনৈতিক আদর্শ সমগ্র পৃথিবীকে যে অর্থনৈতিক সংকট দূর করতে পেরেছিল ইতিহাস তার জ্বলন্ত সাক্ষী। সুতরাং বর্তমানে পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক সংকট বিরাজ করছে, তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্ল্হাু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের আদর্শ দ্বারাই সমাধান সম্ভব, অন্য পথে সম্ভব নয়।
সেমিনারে বলা হয়, বর্তমানে রাজনৈতিক সংকট একটি মারাত্মক ব্যধি হয়ে দেখা দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিরোধী পক্ষকে অবৈধভাবে নাজেহাল করা, আদর্শহীন রাজনৈতিক চর্চা, ক্ষমতায় গেলে যুলম নিপীড়ন চালান, ক্ষমতা কুক্ষিগত করা প্রভৃতি রাজনৈতিক সংকট খুবই প্রকট। স্বৈরচারী, ফ্যাসিস্ট ও কর্তৃত্ববাদী যালিম সরকারের অধীনে দীর্ঘ ১৫ বছর অতিবাহিত করায় এ সংকটের তীব্র জ্বালা এদেশের সকলেই হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে।
অপরদিকে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার খোলস পালটানো আধিপত্যবাদের নব্য সংস্করণ বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াও সারা বিশ্বের জন্য অন্যতম রাজনৈতিক সংকট বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেখানে সেখানে যে কোন বিষয়ে বিশ্বায়নের নামে তার নাক গলানোর কারণে পৃথিবীর অসংখ্য স্বাধীন রাষ্ট্রও আজ তার কাছে অসহায় হয়ে পড়েছে। যে বা যারা আমেরিকা বা অন্যান্য পরাশক্তির স্বার্থ সংরক্ষণ করে, তারা যত বড়ই অপরাধী হোক না কেন, তারাই নির্দোষ, আর যারা এই অনধিকার মোড়লিপনার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে, তারাই ছলে-বলে-কলে-কৌশলে দোষী সাব্যস্ত হচ্ছে। এই হচ্ছে, এখন বিশ্ব রাজনীতির আসল চিত্র। জাতিসংঘও পরাশক্তির হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এ সব পরাশক্তির দ্বিমুখী নীতিও বিশ্ব জুড়ে সংকট আরো জটিল থেকে জটিল হওয়ার বড় কারণ। পূর্ব তিমুর ও কাশ্মীর, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন বিশ্ব মোড়লদের দ্বিমুখী নীতির জাজ্বল্য উদাহরণ। বর্তমানের শক্তিধর কিছু রাষ্ট্রের পরাশক্তি হিসেবে আত্ম প্রকাশের অপচেষ্টাও বিশ্ব রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য সংকট বলেও ধরা যায়। সারা বিশ্বের প্রচার মাধ্যমগুলো সবই ইসলামের শত্রুদের মালিকানাধীন হওয়ার কারণে, নির্লজ্জভাবে ওদের পক্ষেই সাফাই গেয়ে যাচ্ছে বলেও সেমিনারে উল্লেখ করা হয়। অর্থাৎ মিডিয়া আগ্রাসনও আধুনিক বিশ্বের জন্য একটা বিরাট সংকট।
প্রবন্ধে বলা হয়, রাসূলুল্লাহ(সা.) একজন প্রথিতযশা রাজনীতিবিদ ছিলেন। ছিলেন আবিসংবাদিত রাষ্ট্র প্রধান। প্রতিপক্ষের সাথে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ছিল তার নির্মল আদর্শেরই অংশ। তিনি প্রভাবশালী রাষ্ট্র প্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকার পরেও বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য অনেক ছাড় দিয়ে অসম শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছেন। বিশ্বে সর্ব প্রথম রচিত বহুপাক্ষিক শান্তি চুক্তির জাজ্বল্য নযীর ‘মদীনার সনদ’ বিশ্ব ইতিহাসে আজ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। অসম শান্তি চুক্তির ক্ষেত্রে তাঁর হুদায়বিয়ার সন্ধির কথা কে বা না জানে ? চুক্তির শর্তসমূহের ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত হলেও তখনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। সে সময় আবূ জান্দাল(রা.) নামক এক নও মুসলিমকে অত্যাচারী কুরায়িশদের কাছে ফেরত পাঠিয়ে তিনি চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার এক জ্বলন্ত উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন।
মহানবীর(সা.) রাজনীতির বৈশিষ্ট্যই ছিল প্রতিশোধ নয়। ভ্রাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, ক্ষমা, সদাচরণ, সততা, সমব্যবহার প্রভৃতি উন্নত গুণাবলিই ছিল মহানবীর (সা.) রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। তিনি আল্লাহ কর্তৃক বিশ্বনবী হয়েই প্রেরিত। সেজন্য তাঁর আদর্শই হচ্ছে, বিশ্বায়নের জন্য একমাত্র যোগ্য ও মানানসই, আমেরিকার মত মুসলিম বিদ্বেষী দোমুখী নীতির আদর্শ বিশ্বায়নের জন্য মোটেও মানানসই নয়। আজ বিশ্বনবীর(সা.) রাজনৈতিক গুণাবলি অনুসরণ করলে পৃথিবীর রাজনৈতিক আকাশে যে বিভিন্ন সংকটের ঘনঘটা বিরাজ করছে, তা থেকে উত্তরণ হওয়া সহজেই সম্ভব বলেও সেমিনারে উল্লেখ করা হয়।
সেমিনারে বিচার বিভাগ, অপরাধ প্রবণতা, ধ্বংসাত্মক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, স্বৈরাচার ও পরাশক্তি, ঘাতক দুরারোগ্য ব্যধি, ধর্মীয়, আদর্শিক এবং সামাজিক সংকটের কথা তুলে ধরে এ থেকে মুক্তির জন্য মহানবীর(সা.) আদর্শ বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়।