সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : বেপরোয়া আহরণ, জমিতে অতিমাত্রায় কিটণাষাক ব্যবহার ও দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে পরিবেশ ভারসাম্যের খুবই উপকারী জলশপ্রাণী শামুক হারিয়ে যাচ্ছে উপকুলীয় জেলা সাতক্ষীরা থেকে।
এসব শামুকের মধ্যে রয়েছে সোনালী গ্লোবোজা শামুক, জোংড়া শাকুম, গুলিশামুক, স্ক্রু শামুক ও কেচো উল্লেখযোগ্য। খাল, বিল, পুকুর, ডোবা জলাশায় থেকে বিভিন্ন প্রজাতির এই শামুক সংগ্রহ করে বিক্রি করা হচ্ছে।
পরিবেশ বিষেশজ্ঞদের মতে প্রকৃতির ফিল্টার নামে খ্যাত শামুক এভাবেই ধংস করে ফেললে পরিবেশের হুমকির কারন হয়ে দাড়াবে। প্রাকৃতিক ভাবে উৎপন্য এসব শামুক সংরক্ষণ করতে তারা সরকারের এগিয়ে আসার দাবি জানান।
সাতক্ষীরার উপকুলীয় কালিগঞ্জ উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা ও শামুক গবেষক এই প্রতিপদক্ষে জানান, শামুক যেমন আমাদের পরিবেশের ভারসাম্যকে রক্ষা করে, তেমনি মৎস্য ও ফসলের জন্য খুবই উপকারী একটি জলশপ্রাণী। তিনি বলেন, জলাশয়, ডোবা, পুকুর ও বিলের পানিকে পরিস্কার রাখে বিভিন্ন প্রজাতির শামুক। একই সাথে পানি ও জমির ক্ষতিকর পোকা মাকড় খেয়ে ফেলে শামুকে। তাছাড়া শামুক ইদুর, সাপ ও ব্যাঙ এর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয় বলে জানান তিনি। কিন্ত জমিতে অতিমাত্রায় কিটণাষক ব্যবহার এবং বেপরোয়া ভাবে আহরনের কারনে শামুক দ্রুত কমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর সাতক্ষীরা সহকারী পরিচালক সরদার শরিফুল জানান, শামুককে পরিবেশের বন্ধু বলা হয়। এ জলশপ্রাণীটি আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য যেমন রক্ষা করে তেমনি, জমির উর্বরতা বৃদ্ধি ও পানিকে ফিল্টার করা ছাড়াও সাপ ও অন্যান্য প্রাণির খাদ্য হিসেবে শামুক অনেক বড় ভুমিকা রাখে। আর এই উপকারী জলশপ্রাণী শামুক হুমকির মুখে রয়েছে বলে জানান তিনি। শামুক দ্রুত হারিয়ে যাওয়ার যে সব কারন রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত। শামুকের নিরাপদ আবাসস্থল হচ্ছে উন্মুক্ত জলাশায়, ডোবা, পুকুর ও বিল। কিন্ত দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারনে উন্মুক্ত জলাশয় ও ডোবা শুকিয়ে তাদের আবাসস্থল নষ্ট যাচ্ছে। এতে করে প্রজনন ব্যবস্থা যেমন কমে যাচ্ছে তেমনি জমিতে অতিমাত্রায় কিটণাষক ব্যবহারের ফলেও প্রচুর পরিমান শামুক মারা যাচ্ছে।
সাতক্ষীরা সরকারী কলেজের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. অলিউর রহমান জানান, শামুক অত্যন্ত উপকারী জলশপ্রাণী। জলাশয়ের আবর্জনা পরিস্কার রাখাসহ বিভিন্ন প্রাণীর খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার হয় শামুক। মাছ ও হাঁস মুরগীর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার পর শামুকের খোলস অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করা হয়। আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এ জলশপ্রাণীটি টিকিয়ে রাখতে হবে। মানুষকে অযাযিত ভাবে শামুকের আবাসস্থল নষ্ট ও তাদের বেপরোয়া ভাবে আহরন করা বন্ধ করতে হবে।
বাংলাদেশ বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্টান (বারসিক) এর শামুক গবেষক শেখ তানজির হোসেন নাহিদ জানান, পরিবেশে সম্পূর্ণ নিজস্বতা নিয়ে টিকে থাকলেও নানা কারণে শামুক কমে যাচ্ছে । এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, প্রজননের সময় শামুক উত্তোলন ও বিক্রি, মাছের খাদ্য হিসেবে ঘেরে ব্যবহার, চুন তৈরি, ডিমওয়ালা শামুক নিধন, শামুকের আশ্রয়স্থল কমে যাওয়া, জলাশয় কমে যাওয়া, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, হাঁসের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার, কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধির ফলে শামুকের প্রজনন এবং বংশবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব, ছোট শামুক বিনষ্ট করা, বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে লবণাক্ততা বৃদ্ধি। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাসহ মানুষ শামুক কর্তৃক নানাভাবে উপকৃত হচ্ছে, কিন্তু একটি ক্ষণের জন্যও শামুক রক্ষার কথা ভাবছে না কেউ। ফলশ্রুতিতে শামুক আজ বিলুপ্ত প্রায়। তিনি আরে বলেন, শামুক কমে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন মাছ যেমন কৈ, শোল, শিং প্রভৃতির প্রিয় খাদ্যের তালিকায় রয়েছে শামুক। তাই শামুক কমে গেলে দেশীয় মাছও কমে যায়। সাধারণত, উল্লিখিত মাছগুলো রেণু অবস্থায় শামুকের ডিম খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু সাতক্ষীরা একটি ঘের অধ্যুষিত এলাকা এবং সাতক্ষীরা থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমান মৎস্য সম্পদ দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হয়, সেহেতু প্রত্যেক ঘের মালিককে নিজ ঘেরের চাহিদা মেটানোর জন্য প্রয়োজনীয় শামুক চাষে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া ফসল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে। এতে একদিকে যেমন, শামুকের বংশবৃদ্ধি ব্যাহত হবে না, তেমনি জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়বে না।
শামুক রক্ষায় অধিকাংশ বিষশজ্ঞদের মতামত সাতক্ষীরার সকল জলাশয় ঘের, পুকুর, বিল, ও খাল থেকে শামুক উত্তোলন করতে না পারেন, সেজন্য প্রত্যেক জমিতে ছোট ছোট সাইনবোর্ড স্থাপন করে শামুকের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা যেতে পারে। এতে বন্য প্রাণি (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ধারা ৬ ও ৩৪ উল্লেখ করে লেখা থাকবে এই জমি, পুকুর,ঘের থেকে শামুক ধরা নিষধ করাসহ সরকারের কৃষি বিভাগসহ পরিবেশ, কৃষি ও মৎস্য সম্পর্কিত সকল বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষ করে প্রশিক্ষণ, সভা, সেমিনার, মাঠ দিবসের মতো কর্মসূচিতে শামুক রক্ষার আহবান জানানোর উদ্যোগ সংযুক্ত করতে হবে।