সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগের সহকারী ডিরেক্টর, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা সংস্কারক, দেশ বরেণ্য সমাজ সেবক, মানবতাবাদী , প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং সর্বজন শ্রদ্ধেয় খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) ছিলেন তৎকালীন বাঙালি মুসলমানের অহংকার এবং তাঁর কালের আলোকিত মানুষ।
জন্ম ও শিক্ষা জীবন
উপমহাদেশের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষীর জন্ম সাতক্ষীরা জেলার নলতা গ্রামে ১৮৭৩ সালে। তাঁর শিক্ষা জীবন শুরু হয় স্বগ্রামেই। মতিলাল ভঞ্জচৌধুরী নামে একজন শিক্ষকের কাছে হাতেখড়ি। তারপর প্রথমে নলতা মধ্য ইংরেজী বিদ্যালয়ে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার টাকি উচ্চ বিদ্যালয়ে। এরপর ১৮৯০ সালে ভবানীপুর লন্ডন মিশনারী স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ সালে হুগলী কলেজ থেকে এফ.এ, ১৮৯৪ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৮৯৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এম.এ পাস করেন।
কর্ম জীবন
শিক্ষাজীবন সমাপনান্তে শুরু হয় তাঁর চাকুরি জীবন। ১৮৯৬ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের সুপারনিউমারী শিক্ষক। মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে উচ্চতর বেতনে অস্থায়ীভাবে ফরিদপুরের শিক্ষাবিভাগীয় অতিরিক্ত ডেপুটি ইন্সপেক্টর, ছ’ মাসের মধ্যে সাব-ইন্সপেক্টর অব স্কুল্স। এরপর অপেক্ষাকৃত বৃহত্তর জেলা বাখেরগঞ্জের ডেপুটি ইন্সপেক্টরের স্থায়ীপদে। কিছুদিন পর শিক্ষা বিভাগীয় ইন্সপেক্টিং লাইন ছেড়ে চলে আসেন শিক্ষকতা লাইনে। ১৯০৪ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলের হেড মাষ্টার পদে নিযুক্তি পান। উক্ত পদে তাঁর দায়িত্ব পালনে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ সন্তুুষ্ট হয়ে ১৯০৭ সালে তাঁকে চট্টগ্রাম বিভাগের ডিভিশনাল ইন্সপেক্টর পদে নিয়োগ প্রদান করে। ১৯১২ সালে প্রেসিডেন্সি বিভাগের অতিরিক্ত ইন্সপেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে চলে যান কলকাতায়।
ইতোমধ্যে তিনি আই. ই. এস (ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস)-এর অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯২৪ সালে অবিভক্ত বাংলা ও আসামের শিক্ষা বিভাগীয় সহকারি পরিচালকের পদে নিযুক্তি লাভ করেন।
শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে অবদান
বৃটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে তিনিই একমাত্র ব্যাক্তি যিনি উক্ত এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল ও যুগান্তকারী পরিবর্তন ও সংস্কার সাধন করেন।
যার মধ্যে অন্যতম
১. পরীক্ষার খাতায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায় পরীক্ষার্থীর নাম লেখার পরিবর্তে রোল নম্বর লেখার রীতি প্রবর্তন,
২.উচ্চ মাদ্রাসা শিক্ষামান উন্নীতকরণ, মাদ্রাসা পাশ ছাত্রদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার অনুকূল সুযোগ সৃষ্টি,
৩.সকল স্কুল কলেজে মৌলভীর পদ সৃষ্টি এবং পন্ডিত (হিন্দু শিক্ষক) ও মৌলভীর বেতনের পার্থক্য রহিত করণ।
৪.স্বতন্ত্র পাঠ্যসূচী নির্ধারণ করতঃ মুসলমান ছাত্রদের ৫.শিক্ষার জন্য মুসলমান লেখকের লেখা পুস্তক ব্যবহারের প্রবর্তন,
৬.মুসলমান লেখক ও সমৃদ্ধশীল মুসলিম সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহ প্রদানের জন্য মখদুম লাইব্রেরী, প্রভিন্সিয়াল লাইব্রেরী, ইসলামিয়া লাইব্রেরী প্রভৃতি পুস্তক প্রকাশনা সংস্থা প্রতিষ্ঠা।
৭.স্কুল কলেজে মুসলমান ছাত্রদের বৃত্তির আনুপাতিক সংখ্যা নির্ধারণ, বৈদেশিক উচ্চশিক্ষার জন্য মুসলমান ছাত্রদের সরকারি বৃত্তি প্রাপ্তির পথ সুগমকরণ।
৮.টেক্সট বুক কমিটিতে মুসলিম সদস্য নিয়োগ, পরীক্ষক, শিক্ষা বিভাগীয় কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি প্রভৃতি স্থানে আনুপাতিকহারে মুসলমানদের আসন সংখ্যা নির্ধারণ, নিউ স্কীম মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা,
৯. হাইস্কুলে আরবীকে অধিকতরভাবে সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ করা, আরবী শিক্ষার মধ্যস্থতায় ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা করা,
১০.মুসলমান ছাত্রীদের উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশেষ বিশেষ স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা-
এমনি আরো অনেক। নিচে পড়ে থাকা মুসলিম সমাজকে স্বমহিমায় উজ্জীবন ও প্রতিষ্ঠার জন্য এমন সব মহতী কর্মে তিনি ব্রতী ছিলেন।
কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ, বেকার হোস্টেল, কারমাইকেল হোস্টেল, টেলর হোস্টেল, রাজশাহীর ফুলার হোস্টেল ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে তিনি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় অবদান ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খসড়া বিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে উত্থাপিত হলে দারুন বিরোধের সৃষ্টি হয় এবং পরে এটি বিবেচনার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠিত হয়। খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) এই কমিটির অন্যতম সদস্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবশ্যকতা সমর্থন করে এর অনুকলে বলিষ্ঠ কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
“খান বাহাদুর” উপাধি লাভ
১৯১১ সালে তিনি বৃটিশ ভারতের ‘রয়েল সোসাইটি ফর এনকারেজমেন্ট অব আর্টস, ম্যানুফাকচারার্স এন্ড কমার্স’- এর সদস্য পদ লাভ করেন। একই বছরে শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বৃটিশ সরকার তাঁকে ‘খানবাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করে।
১৯২৯ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ৯২ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
তাঁর লেখা গ্রন্থ
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য ছিল। তাঁর লিখিত অন্যান্য গ্রন্থগুলো ছাড়াও ‘বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থটি তার বিশেষ স্বাক্ষর বহন করে। তাঁর এ গ্রন্থে আছে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর প্রাজ্ঞতা ও সাহিত্য বিনির্মাণে তাঁর মূল্যবান দিকনির্দেশনা। তাঁর লেখা সব গ্রন্থে আছে ভাষাশৈলী বির্নিমাণে তাঁর পান্ডিত্যের প্রমাণ। সেকালের অন্যতম শক্তিধর লেখক হজরত খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা (রঃ) সমাজ ও দেশ, বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, শিক্ষা, ধর্ম, জীবন কথা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে ৭৯টি অতি মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এসকল গ্রন্থ ‘খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লা রচনাবলী’ নামে ১২ খন্ডে প্রকাশ করা হয়েছে।
সমাজ সংস্কারে তাঁর অবদান
শৈশব থেকে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি অধ্যাত্ম-চিন্তা ও সাধনায় জীবন অতিবাহিত করেছেন। শুধু আল্লাহ সাধনাই নয়, তাঁর সৃষ্ট জীবকে ভালোবাসা, তাদের কল্যাণে আত্মনিবেদিত হওয়াতে মানব জীবনের পূর্ণত্ব – এই ছিল তাঁর জীবন-সাধনা। এই ভাবাদর্শের ভিত্তিতে ‘স্রষ্টার এবাদত ও সৃষ্টের সেবা’- এই মূলমন্ত্র নিয়ে ১৯৩৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নলতা কেন্দ্রীয় আহ্ছানিয়া মিশন’। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন’, যার সামাজিক ও আত্মিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড আজ স্বদেশের গন্ডি পেরিয়ে বৃহত্তর পরিসরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিব্যাপ্ত।
শেষ কথা
জীবনের প্রায় পুরোটা সময় অনগ্রসর মুসলমানদের উন্নতির জন্য ব্যয় করেছেন। ইংরেজ শাসনাধীন ভারতে মুসলমানদের যে ক্ষয়িষ্ণু অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গির যে পশ্চাৎপদতা, সাংস্কৃতিক যে অবক্ষয় তাকে নতুন জীবনদৃষ্টি ও বিশ্ববীক্ষা নির্মাণে তিনি পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন।