1. news@sangjogprotidin.online : ADMIN : ADMIN ADMIN
  2. info@www.sangjogprotidin.online : দৈনিক সংযোগ প্রতিদিন :
শনিবার, ০৭ জুন ২০২৫, ০৯:০৯ অপরাহ্ন
বিজ্ঞপ্তি :
জরুরী সাংবাদিক নিয়োগ চলছে আপনার কাছে একটি দুর্দান্ত সুযোগ! "সংযোগ প্রতিদিন" সংবাদপত্রে জরুরী ভিত্তিতে সাংবাদিক নিয়োগ চলছে।

লবণাক্ততার কারণে দক্ষিণাঞ্চলে মাটির উর্বরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস,উৎপাদন ব্যাহত

  • প্রকাশিত: মঙ্গলবার, ৩ জুন, ২০২৫

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাত বছরের নীলা ভোরবেলা উঠে মাটির ঘরে রাখা ছোট্ট কলস নিয়ে হাঁটতে শুরু করে। তার গন্তব্য মিষ্টি পানির শেষ উৎস গ্রাম থেকে প্রায় হাফ কিলোমিটার দূরে একমাত্র টিউবওয়েলটি,যা এখনও পুরোপুরি লবণাক্ত হয়নি। স্কুলে যেতে দেরি হবে জেনেও তার মা বলে দিয়েছেন আগে পানি আনো, তারপর পড়া।এটাই আজকের বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চলের বাস্তবতা। খুলনা, বাগেরহাট আর সাতক্ষীরার হাজারো নীলা, রফিক, খালেদার জীবন । প্রতিদিনই লড়াই জল, জমি আর জীবনকে রক্ষার জন্য।জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এই অঞ্চলের জমি লবণাক্ত করে তুলেছে, মাটির উর্বরতা হারিয়েছে। পুকুরের পানি বিষের মতো নোনা হয়ে উঠেছে। এক সময়ের ধান-পাটে ভরা মাঠ এখন শুকনো, ফেটে যাওয়া মাটির গালিচা। পুকুরে মাছ নেই, খেতে ধান নেই, শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাবার নেই।আগে যেখানে ধান হতো, এখন সেখানে কিছুই হয় না। শুধু নোনাপানি আর হতাশা। বলছিলেন পাইকগাছার কৃষক নাসির উদ্দিন।এক সময়ের চিংড়ি রপ্তানির গর্ব আজ রোগ আর লোকসানে ভরা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, ২০২০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে চিংড়ির উৎপাদন ২০% কমেছে। ধানের ক্ষেতেও একই গল্প ২০২০ সালে ৭.২ লক্ষ টন উৎপাদন এখন ৬.১ লক্ষ টনে নেমে এসেছে।বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চল বিশেষ করে খুলনা, বাগেরহাট এবং সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হয়ে পড়ছে। এর ফলে এই অঞ্চলের কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন হ্রাস, জলবাহিত রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্যের হার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে উঠছে।বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০২০-২০২৩ সালে চিংড়ি উৎপাদন ২০% হ্রাস পেয়েছে, যার প্রধান কারণ লবণাক্ততা ও হোয়াইট স্পট সিন্ড্রোম রোগ। মৎস্যজীবীরা এখন অনুপযুক্ত জমিতে মাছচাষ করছে, যা প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করছে। ধান, পাট, সবজি এই অঞ্চলের প্রধান কৃষিপণ্যগুলেও লবণাক্ততায় হুমকির মুখে। বিআরআরআই ধান-৬৭, ৮৯, বিনা ধান-১০ লবণসহিষ্ণু হলেও এখনও বিস্তৃত আকারে চাষ হচ্ছে না। বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজ (ইঈঅঝ) ও ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ওঋচজও) এর ২০২৩ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, উপক‚লীয় অঞ্চলে বছরে গড়ে ৬৮ হেক্টর আবাদি জমি লবণাক্ততার কারণে অনাবাদিতে পরিণত হচ্ছে। ২০৫০ সালের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষি উৎপাদন ৩০-৪০% হ্রাস পেতে পারে।২০২০ সালে এ অঞ্চলে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ হাজার টন । ২০২৩ সালে উৎপাদন হয়েছে ২৮ হাজার টন। ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে ২০২০ সালে ৭.২ লক্ষ টন । ২০২৩ সালে হ্রাস পেয়ে ৬.১ লক্ষ টন উৎপাদন হয়েছে।ঋঅঙ এবং ওচঈঈ (ওহঃবৎমড়াবৎহসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন ৮% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে, যা বছরে ৩৫-৪০ লাখ টন খাদ্য ঘাটতির সমান। গম উৎপাদন ৩২% হ্রাস পেলে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলে বোরো মৌসুমে ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ১০-১৫% কমেছে।বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (ইঅজঈ) এর তথ্য অনুসারে দেশের উপক‚লীয় এলাকায় লবণাক্ততা ১৯৭৩ সালে যেখানে ছিল ৮.৩ লাখ হেক্টর, ২০১৯ সালে তা দাঁড়িয়েছে ১০.৬ লাখ হেক্টরে। প্রতি বছর গড়ে ১% হারে কৃষিজমি লবণাক্ততায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (ইইঝ) এর ২০২২ সালের এক জরিপ অনুসারে দক্ষিণাঞ্চলে কৃষকের ৬৭% মনে করেন লবণাক্ততা ও খরার কারণে তাদের জমির উৎপাদনশীলতা কমছে। ৫৪% কৃষক বিকল্প জীবিকার সন্ধানে গেছেন, যার মধ্যে মাছ চাষ ও খামার গড়ে তোলার উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য।খুলনার পাইকগাছার কৃষক মোহাম্মদ আলম বলেন গত ১০ বছরে আমাদের জমির উর্বরতা অর্ধেকে নেমে গেছে। আগের মতো ধান ফলছে না, বোরো মৌসুমে সেচের জন্য মিষ্টি পানির অভাব তীব্র। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মৎস্যজীবী খালেক শেখ জানান,লবণাক্ততার কারণে মিষ্টি পানির মাছের চাষ বন্ধ হয়ে গেছে, বাধ্য হয়ে অনেকেই বাগদা চিংড়ির দিকে ঝুঁকছে, কিন্তু তাতেও ঝুঁকি বেশি।লবণাক্ততা অনেক এলাকার নলক‚পে পৌঁছে গেছে, ফলে পানযোগ্য পানি পাওয়া কঠিন। পুকুরের পানি পানযোগ্যতা হারিয়েছে। ফলে ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস, জন্ডিসের মতো রোগের প্রকোপ বাড়ছে। স্বাস্থ্য বাজেট অপর্যাপ্ত, স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো রোগীর চাপে বিপর্যস্ত। নারী ও কিশোরীরা সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে। দূর-দূরান্ত থেকে পানি সংগ্রহ, খারাপ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, পুষ্টিহীনতা ও প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যা। আর্থিক ক্ষতি ও বাস্তুচ্যুতির কারণে মানসিক চাপ দিন দিন বাড়ছে।স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০,০০০ জনে জলবাহিত রোগের হার ২০২০ সালের ৪০ থেকে ২০২৩ সালে বেড়ে ৬৫ জনে উন্নীত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন কমায় আয়ের পথ সংকুচিত হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের মতে, ২০২০ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ৪০% ছিল, ২০২৩ সালে তা ৪৫% ছাড়িয়েছে। ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়ছে।স্থানীয় কৃষক নাসির উদ্দিন বলেন, লবণাক্ততা এত বেড়েছে যে, ধানের ফলন আগের চেয়ে অর্ধেক হয়েছে। মাছও মরে যাচ্ছে। আমাদের জীবিকা ধ্বংসের পথে। অন্যদিকে, সাতক্ষীরা জেলার স্বাস্থ্যকর্মী শিরিন আক্তার জানান, খাবার পানির অভাবে ও টয়লেটের দূরবস্থা রোগ বাড়াচ্ছে। রোগীরা দিনে দিনে বাড়ছে, কিন্তু চিকিৎসার সুযোগ কম। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় অবিলম্বে সঠিক প্রযুক্তি, লবণ সহনশীল ফসল, এবং মৎস্য খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন।জলবায়ু অভিবাসন ও দারিদ্র্যের উত্থান ঘটেছে। কয়রা, শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলায় দারিদ্র্যের হার ৪০% এর বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসন বেড়ে চলেছে, ফলে খুলনা, যশোরসহ শহরাঞ্চলে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীবিকা হারিয়ে হাজারো পরিবার জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পড়ছে।আইপিসিসি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের ১৭% উপক‚লীয় ভূমি প্লাবিত করতে পারে। এতে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষণায় লবণাক্ততার সাথে উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভকালীন জটিলতা, চর্মরোগের সরাসরি যোগ রয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব মতে, জলবায়ু-প্রভাবে ফসলহানি ও স্বাস্থ্য সংকটে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের জিডিপি ২.৯% হ্রাস পেতে পারে।বিশেষজ্ঞদের মতে বাংলাদেশের উপক‚লীয় অঞ্চল শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে নয়, বরং অর্থনৈতিক, স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ঘূর্ণিঝড়, লবণাক্ততা, পানি সংকট এবং সামাজিক বৈষম্য এই সংকটকে আরও ঘনীভূত করছে।এখন সময় নীতিগত, বৈজ্ঞানিক এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার। উপক‚ল রক্ষা মানেই দেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫
১৬১৭১৮১৯২০২১২২
২৩২৪২৫২৬২৭২৮২৯
৩০  
© সংযোগ প্রতিদিন
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট