সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে এক নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে ঠিক করা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা সীমার মধ্যেই থাকলেও বিশ্বের উপকূলীয় অঞ্চলগুলো নিরাপদ নয়। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়া বন্ধ না-ও হতে পারে। এর ফলে লাখ লাখ উপকূলবাসী মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে, এমনকি বিশ্বের বহু ধনী দেশও এই পরিবর্তনের প্রভাব সামাল দিতে হিমশিম খাবে।
বিজ্ঞানীরা জানান, অতীতের জলবায়ু পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমান সময় থেকে প্রায় ১ লাখ ২৫ হাজার বছর এবং ৩০ লাখ বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রা আজকের মতোই ছিল। সে সময় বিশাল আকারে বরফ গলে সমুদ্রের উচ্চতা অনেক বেড়ে যায়। আজও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে — গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম আন্টার্কটিকায় বরফ গলার হার বাড়ছে।
যদিও পূর্ব আন্টার্কটিকা তুলনামূলকভাবে এখনও স্থিতিশীল, তবে কম্পিউটার মডেলগুলো বলছে, বরফ গলা একেবারে থেমে যাবে না। বিজ্ঞানীদের ভাষায়, ১.৫ ডিগ্রির সীমা বজায় রাখলেও ভবিষ্যতে সমুদ্রপৃষ্ঠ বাড়তেই থাকবে, যদিও হয়তো গতি কিছুটা কমবে। এ কারণে এখন থেকেই সতর্ক না হলে ভয়াবহ জলবায়ু অভিবাসন, সম্পদহানি ও জীবনযাত্রার সংকট দেখা দিতে পারে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ২৩ কোটি মানুষ সমুদ্রের জোয়ার রেখা থেকে মাত্র ১ মিটারের মধ্যে বাস করছে। যদি প্রতি বছর মাত্র ১ সেন্টিমিটার করে পানির উচ্চতা বাড়ে, তবুও তা মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। শুধু দরিদ্র দেশ নয়, উন্নত দেশগুলোও এর ফল ভোগ করবে। বাড়বে উপকূলীয় ভাঙন, দুর্যোগ, আর শুরু হতে পারে ব্যাপক ‘জলবায়ু অভিবাসন’।
তবে সব শঙ্কার মধ্যেও বিজ্ঞানীরা আশার কথা বলেছেন— এখনো সময় আছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা গেলে ভবিষ্যতের এই ধ্বংসাত্মক পরিবর্তন কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব। তাই এখনই কার্যকর পদক্ষেপ জরুরি, শুধু চুক্তির প্রতিশ্রুতি নয়, চাই বাস্তবায়নের সাহসিকতা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। দিন দিন বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে এসব জনপদ। বছরের পর বছর প্রকৃতির বিরূপ আচরণের সঙ্গে মানুষ খাপ খাওয়াতে না পেরে ভিটামাটি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে। এতে তৈরি হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থানসহ জীবনযাত্রায় নানা সংকট। এদিকে উপকূলীয় অঞ্চলকে মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সুন্দরবনও ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রতি বছর আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে যে সুন্দরবনের প্রভাবে এসব জনপদে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হয়; সেই সুন্দরবনও আজ ভালো নেই। বিষ দিয়ে মাছ শিকার, অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারীদের নির্বিচারে গাছ নিধন এবং চোরা শিকারিদের হাতে মরছে বাঘ-হরিণসহ সুন্দরবনের নানা প্রজাতির প্রাণী। এভাবে সুন্দরবন ধ্বংস হতে হতে উপকূলীয় জনপদও একটি সময় বিলীন হয়ে যাবে—এমন আশঙ্কা বহু আগে থেকে করা হচ্ছে। এর পরও সুন্দরবন বাঁচাতে কিংবা উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা করতে দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় বা বৃষ্টি মৌসুমে যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, সেগুলোও কোনো কাজে আসছে না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দিন দিন কৃষিজমির পরিমাণ কমে আসছে। মানুষ বাধ্য হয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে পেশা পরিবর্তন করছে। বিশেষ করে খুলনার কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ, সাতক্ষীরা শ্যামনগর এবং আশাশুনি, বাগেরহাটের শরণখোলায় বর্তমানে গবাদি পশুর উৎপাদন কমে গেছে।
বৈশ্বিক উষ্ণতায় গ্রীষ্মের সময় প্রচণ্ড গরম পড়ছে। শীতের সময় অধিক পরিমাণে শীত এবং বর্ষা মৌসুমে অতিবৃষ্টির ফলে দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে উপকূলীয় জনপদে। মানুষ নদীভাঙনের শিকার হয়ে এলাকা ছাড়ছে। কিন্তু এভাবে চলতে থাকলে এমন একটি সময় আসবে, যখন দেশের মানচিত্র থেকে উপকূলীয় এসব অঞ্চল হারিয়ে যাবে—তা আর বেশি দূরে নই। তাই এসব অঞ্চল টিকিয়ে রাখতে সরকারের আরও আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা প্রয়োজন। আমরা দেখেছি, প্রতি বছর যখন বর্ষা মৌসুমে নদীভাঙন দেখা দেয়, তখন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের টনক নড়ে। তারা তখন বেড়িবাঁধ দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়। কিন্তু সে বাঁধ বছর না যেতেই নদীর সঙ্গে মিশে যায়। এতে একদিকে যেমন প্রতি বছর সরকারের অর্থের অপচয় ঘটছে, অন্যদিকে দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়ছে। তাই বেড়িবাঁধ নির্মাণে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি এসব অঞ্চলের লবণাক্ত জমিতে লবণ সহনশীল ফসল উৎপাদনে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে এসব জনপদে যাতে গবাদি পশুর উৎপাদন কমে না যায়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে গোখাদ্য উৎপাদনে সরকারের সহযোগিতা বাড়াতে হবে। খামারি বা স্থানীয়দের গবাদি পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করতে হবে। গবাদি পশুর চিকিৎসায় উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তাসহ সরকারিভাবে আরও নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। যাতে সহজে কোনো পশু রোগে আক্রান্ত হলে তারা চিকিৎসা নিতে পারে। প্রয়োজনে গবাদি পশুর উৎপাদন বাড়াতে সরকারের ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। আশা রাখি, উপকূলীয় জনপদে গবাদি পশুর উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।