শ্যামনগর প্রতিনিধি : পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত বনভূমি সুন্দরবন। বাংলাদেশ ও ভারতে বিস্তৃত এই প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বনের মোট আয়তন ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। সুন্দরবনের মোট আয়তনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে অবস্থিত। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশের আয়তন বন অধিদপ্তরের মতে, ৬ হাজার ১৭ বর্গ কি.মি. বা ২ হাজার ৩২৩ বর্গমাইল। তবে মাধমিক ভূগোল ও পরিবেশ বইয়ে বনটির আয়াতন উল্লেখ করা হয়েছে ৬ হাজার বর্গ কি.মি. বা ২ হাজার ৩১৭ বর্গমাইল। বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট জেলায় সুন্দরবনের বেশির ভাগ এলাকা অবস্থিত। মাত্র ৯৫ বর্গকিলোমিটার পটুয়াখালী ও বরগুনায় অবস্থিত। সংযুক্ত প্রায় ৪০০ নদী-নালা, খালসহ প্রায় ২০০টি ছোট বড় দ্বীপ ছড়িয়ে আছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত প্রধান প্রধান নদীগুলো হলো পশুর, শিবসা, রায়মঙ্গল, বলেশ্বর প্রভৃতি। সুন্দরবনের পূর্বে বলেশ্বর এবং পশ্চিমে রায়মঙ্গল। সুন্দরবন অংশে বাংলাদেশ ও ভারতকে বিভক্তকারী নদী হাড়িয়াভাঙ্গা। সুন্দরবনের অন্য নাম বাদাবন।
কাটকা, হিরণ পয়েন্ট (সুন্দরবনের দক্ষিণে), দুবলার চর, টাইগার পয়েন্টে (কচিখালী) প্রতিবছর পর্যটকদের প্রচুর সমাগম ঘটে। (উল্লেখ্য: এলিফ্যান্ট পয়েন্ট কক্সবাজারে অবস্থিত।) হিরণ পয়েন্ট, কটকা প্রভৃতি সুন্দরবনের অভয়ারণ্য। প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত হিরণ পয়েন্ট সাধারণভাবে নীল কমল নামে পরিচিত। দুবলার চর একটি ছোট দ্বীপ, এর সমুদ্র সৈকত অতি মনোরম। মৎস্য আহরণ, শুটকি উৎপাদন এবং উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর জন্য এটি বিখ্যাত। দুবলার চর থেকে ১০ কি.মি. দক্ষিণে অবস্থিত একটি দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু দ্বীপ’।
সুন্দরবনকে ‘বাংলাদেশের ফুসফুস’ বলা হয়। সুন্দরী, গরান, গেওয়া, পশুর, ধুন্দুল, কেওড়া, বাইন, ওড়া, হেন্দাল, কাকড়া প্রভৃতি এ এলাকার প্রধান উদ্ভিদ প্রজাতি। সুন্দরী বৃক্ষ ‘লুকিং গ্লাস ট্রি’ নামেও পরিচিত। ‘সুন্দরী’ বৃক্ষের প্রাচুর্যের জন্য এই বনের নামকরণ করা হয়েছে ‘সুন্দরবন’। সুন্দরবনে প্রায় সব খালের পাড়েই ঘনভাবে জন্মে নিপা পাম বা গোলপাতা। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘বাউয়াল’দের পেশা গোলপাতা সংগ্রহ করা।
সুন্দরী বড় বড় খুঁটি তৈরিতে, গেওয়া নিউজপ্রিন্ট ও দিয়াশলাই কারখানায়, ধুন্দুল পেন্সিল তৈরিতে, গরান বৃক্ষের ছালের কষ রং তৈরি, জাল রং করা ও চামড়া পাকা করার কাজে এবং গোলপাতা ঘরের ছাউনিতে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের বনসম্পদকে কেন্দ্র করে কয়েকটি শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিল এবং হার্ডবোর্ড মিলস। প্রথমটির কাঁচামাল গেওয়া এবং দ্বিতীয়টির সুন্দরী বৃক্ষ।
সুন্দরবনে ব্যাপক প্রাণিবৈচিত্র্য বিদ্যমান। সুন্দরবন সুদর্শন ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ এর আবাসস্থল। সুন্দরবনে দুই ধরনের হরিণ পাওয়া যায়। যথা— মায়া হরিণ (Barking Deer) এবং চিত্রা হরিণ (Spotted Deer)। এ বনে তিন প্রজাতির কচ্ছপ (কেটো কাছিম, সুন্দি কাছিম, ধুম তরুণাস্থি কাছিম) দেখা যায়। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে গিরগিটি, রেসাস বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, সজারু, উদ, বন্য শূকর, মোহনা কুমির, গুই সাপ, অজগর, হরিয়াল, বালিহাস, গাঙচিল, ডলফিন, ঈগল, চিল, মাছরাঙা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
সরকারিভাবে পরিচালিত দেশের একমাত্র কুমির প্রজনন কেন্দ্র খুলনার করমজলে (সুন্দরবনে) অবস্থিত। এখানকার অর্থনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি মৌমাছি। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘মৌয়াল’দের পেশা মধু সংগ্রহ করা। সুন্দরবনে বাঘের পায়ের ছাপ (পাগমার্ক) গণনা করে বাঘশুমারি করা হতো। তবে ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ (ক্যামেরা ফাঁদ) পদ্ধতিতে বাঘ গণণা করে বন অধিদপ্তর। সুন্দরবন অঞ্চলের কিংবদন্তী শিকারি পচাব্দী গাজী। তিনি ৫৭টি বাঘ শিকার করেছেন।