শ্যামনাগর সাতক্ষীরা মসুন্দরবনে পা রাখিনি তখনও কেবল জলে ভাসছি, ছাউনিওয়ালা নৌকায় ভাসতে ভাসতে ভালোবেসে ফেললাম সুন্দরবনকে! ছোটবেলা থেকে ভ্রমণপিপাসু হলেও সুন্দরবনে যাওয়া হয় একটু বড় হয়ে। তখন গবেষণা শুরু করেছি। সুন্দরবনে শরণার্থী ও হড্ডা গণহত্যা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সুন্দরবনে র্পূব থেকে পশ্চিম প্রায় শতবারের ওপরে যাওয়া হয়। যেতে যেতে সুন্দরবনের মানুষের কাছে পৌঁছে যাই। মিশে যাই তাদের দুঃখ-কষ্টের সঙ্গে। এমনকি বনের জীব-উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে বিমোহিত হই। প্রকৃতির সান্নিধ্যে চলে যাই।
জল থেকে নেমে প্রথম যেদিন ‘ভয়ঙ্কর সুন্দর’ সুন্দরবনে পা দিলাম, পা পড়লো ঠিক গহীন কাদায়। টের পেলাম পায়ের নিচে শক্ত কি যেনো পা ফুটো করে দিচ্ছে। ব্যথায় বসে পড়লাম। মহিতোষ দাদা টেনে তুললেন। দেখলেন রক্ত ঝরছে। তাড়াতাড়ি কোনো এক গাছের পাতা ছিঁড়ে চিবিয়ে সেখানে দিতেই রক্ত পড়া বন্ধ হলো। পরে জানলাম পা ফুটো হয়েছে শ্বাসমূলে। সুন্দরবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বা শ্বাসমূল। এক বৃক্ষ বৈচিত্র্যে রক্ত ঝরলো, অন্য বৃক্ষের গুণে তা থেমেও গেলো।
বুঝে গেলাম আমি এক অন্যরকম জীবনের স্বাদ পেতে যাচ্ছি। ছোটকাল থেকে অনুসন্ধিৎসু মনের ডানা মেলা ছিল। তাতে যোগ হলো স্থানীয় জেলে, মৌয়াল-দাদা-বৌদিগণ। অর্থাৎ লোকালয়ের মানুষ, বন-বনানী, নদী খাল নিয়ে অন্যরকম গল্প, লোকগাথা, মিথ ভেতরটিকে আরও উসকে দিল। আড়পাঙ্গাসিয়া, খেজুরদানা ও খোলপেটুইয়া, হড্ডা, ফুলেশ্বরী, ঢেংমারী, ঘাগড়ামারী নদীর চরসহ বনের গভীরে দেখা পেলাম বৃক্ষ বিস্ময়ের। কারা তারা? কেমন তারা? এ এক অনন্য আবিষ্কার। এই আবিষ্কার বা গবেষণা থেকে আমার কোনো ডিগ্রি লাভ হবে না। লাখ টাকাও পাব না। আমার এ অনুসন্ধানের একমাত্র লক্ষ্য, বিশ্বকে এই সুন্দরবন অঞ্চলের অজানা ইতিহাস আর বৈচিত্র্য জানানো। ইতিহাসে অবহেলিত, গভীর বনের নোনা জল-কাদায় হারিয়ে যাওয়া জীবন ও প্রাণ বৈচিত্র্যকে সম্মান করা।
পৃথিবীর অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বনভূমির উদ্ভিদের তুলনায় সুন্দরবনের উদ্ভিদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। কেননা, সুন্দরবনের বুক চিরে লোনা পানি বহমান। ক্ষেত্র বিশেষে প্রবাহিত হয় স্বাদু পানির ধারা। এই বৈশিষ্ট্যই সুন্দরবনকে পৃথক করেছে বিশ্বব্যাপী অন্যান্য ম্যানগ্রোভ বন থেকে। এ বনের পূর্বাঞ্চলীয় অভয়ারণ্যে বেশি দেখা দেয়। এখানে জন্মে সুন্দরী, গেওয়া, পশুর, কেওড়া, আমুর গোলপাতা। পশ্চিমাঞ্চলীয় অভয়ারণ্যে বেশি দেখা দেয় গেওয়া, গরান, হোন্তাল। দক্ষিণাঞ্চলীয় অভয়ারণ্যে বেশি দেখা দেয় গেওয়া গাছ। এই অঞ্চলে লবণাক্ততা বেশি হওয়ায় অন্যান্য সাধারণ গাছ বেশি জন্মাতে দেখা যায় না। সুন্দরবনে কত প্রজাতির গাছ আছে তা বলা মুশকিল। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্রের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গেওয়া, গরান এবং কেওড়া।
১৯০৩ সালে প্রকাশিত প্রেইন-এর হিসাব মতে সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণী এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে। ওই প্রতিবেদনের পর সেখানে বিভিন্ন ম্যানগ্রোভ প্রজাতি ও তাদের শ্রেণীকরণের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। বনজ প্রকৃতিতে খুব কমই অনুসন্ধান করা হয়েছে এসব পরিবর্তনের হিসাব রাখার জন্য । অন্তরের কান দিয়ে এ বনের আরও একটি হৃদয়স্পর্শী আহ্ববান শুনতে পেলে মানব মঙ্গলের জন্য জন্ম নেওয়া এ বন নিজেকে স্বার্থক বলে মনে করবে। বিপর্যস্ত মানবতার পক্ষে নীরবে কথা বলা এ বন অসুস্থ মানষের জীবন বাঁচাতে চায় তার বুকে ধারণ করা বনজবৃক্ষ, বিভিন্ন প্রজাতির গুল্ম, লতার মাধ্যমে সৃষ্টি ভেষজ ওষুধের মাধ্যমে। বর্তমানে দেশ-বিদেশে আধুনিক সভ্য সমাজের মানুষের কাছে ভেষজ ওষুধ জনপ্রিয়। এর গ্রহণযোগ্যতা ও চাহিদা বেড়েছে। শরীরের জন্য বেশ উপযোগী মনে করছেন চিকৎসকরা। সুন্দর বনের গহীন থেকে গহীনে জন্ম নেওয়া লতাপাতা, গুল্ম, বৃক্ষ থেকে মানুষের জীবন রক্ষাকারী মহামূল্যবান ভেষজ ওষুধ উদ্ভাবন সম্ভব। সুন্দরবনের যে গাছগুলোর সঙ্গে আমার নিবিড় পরিচয় হয়েছিল এর অন্যতম বৃক্ষগুলোর কিছু পরিচয় লিপিবদ্ধ করা গেল:
খলিশা: হানিপ্ল্যান্ট হিসেবে খলসি/খলিশা গাছের বেশ কদর সুন্দরবনে। গুল্ম জাতীয় এই বৃক্ষ মার্চ-এপ্রিলে ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। মৌমাছিরা তখন সেই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে গাছে গাছে চাক বাঁধে। সুন্দরবনের খলসি মধু বিখ্যাত ও উন্নতমানের। খলিশা গাছ সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বেশি পাওয়া যায়।
সুন্দরী: সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছ চিরসবুজ ম্যানগ্রোভ শ্রেণির। এ বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী। ধারণা করা হয় এ গাছের নামেই সুন্দরবনের নামকরণ করা হয়েছে। এই বৃক্ষের কাঠ অত্যন্ত টেকসই, মজবুত ও ভারী। সাঁকো, নৌকা, আসবাবপত্র, ঘরের খুঁটি, বৈদ্যুতিক পিলার প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহৃত সুন্দরী বৃক্ষ জ্বালানী হিসেবেও উত্তম। সুন্দরবনের গাছগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো সুন্দরী গাছ।
পশুর: বনের অন্যতম মূল্যবান বৃক্ষ পশুর। এই গাছের নামে একটা নদীর নামকরণ করা হয়েছে। বনের অধিক লোনা অঞ্চলে নদী-খালের তীরে এর বিস্তৃতি। নৌকা, আসবাবপত্র, ঘরের খুঁটি, বৈদ্যুতিক খুঁটি প্রভৃতি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে আসা এই গাছ বর্তমানে কাটা সম্পূর্ণ নিষেধ। মাটির নিচে শত বছরেও নষ্ট হয় না পশুর কাঠ। তাই রেল লাইনে বহুল ব্যবহৃত হয়। বনের জীবাশ্ম হিসেবেও এর গুরুত্ব অনেক।
গেওয়া: সুন্দরবনের সর্বাধিক বর্ধনশীল গাছ। এই গাছ সর্বোচ্চ ১৩ মিটার উঁচু হয়। এর কাণ্ড ও কাঠ বেশ নরম। গেওয়ার প্রধান ব্যবহার ছিল খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের কাঁচামাল হিসেবে। প্যাকিং বক্স, দিয়াশলাই, খুঁটি, পেন্সিল, ঢোল, তবলা ও খেলনা নির্মাণেও এর যথেষ্ট ব্যবহার রয়েছে। এর বাকল জ্বালানী হিসেবে সমাদৃত। গেওয়া ফুল মধুর প্রধান উৎস। এর কঁচিপাতা ও ফল হরিণের খাদ্য। গেওয়ার সাদা রঙয়ের আঠা অত্যন্ত বিষাক্ত। মানুষের চোখে লাগলে দৃষ্টি শক্তি নষ্ট হতে পারে।
গরান: গরান ঝোপ জাতীয় উদ্ভিদ। এর কাঠ অন্যতম সেরা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বনের প্রায় সর্বত্রই কম-বেশি গরান দেখা যায়। আর লুকাবার স্থান হিসেবে বাঘের পছন্দ এই গরানের ঝোঁপ। ওষুধি গুণসম্পন্ন গরানের ছালের কষ রং তৈরি, জাল রং করা ও চামড়া ট্যান করার কাজে ব্যবহৃত হয়। সুন্দরবনের অন্যতম অর্থকরী উদ্ভিদও গরান। সিডর পরবর্তী সুন্দরবন হইতে গরাণ আহরণ বন্ধ আছে।
কেওড়া : সুন্দরবনের অন্যসব গাছের মতো কেওড়া গাছ মানুষের কাজে খুব একটা না লাগলেও সুন্দরবনের বানর এবং হরিণ অনেকাংশে এই গাছের ওপর নির্ভরশীল। নদী ও খালের কাছেই এই গাছ জন্মায়। এর ফলের স্বাদ টক। কেওড়া ফলের চাটনি বা টক মুখরোচক।
গোলপাতা: সুন্দরবনের অন্যতম খ্যাতিমান গাছ গোলপাতা। নারকেলজাতীয় এই গাছটি মাটির ওপরে মুলাকৃতির কাণ্ড থেকে নারিকেল বা তাল পাতার মতো সরাসরি বেরিয়ে আসে। শাখাহীন এই গাছের ফল আকারে প্রায় ফুটবলের মতো বড়। এর ফল খেতে বেশ সুস্বাদু। কিছুটা তালের শ্বাসের মতো। এই গাছের পাতা দিয়ে ঘর ছাওয়া যায়। সুন্দরবন থেকে প্রতিদিনই প্রচুর পরিমানে এই গাছ নিধন করা হয়। যে কারণে এই গাছ হুমকির মুখে রয়েছে।
এ ছাড়া পরিচয় মিলেছিল কুম্ব, সুন্দরী লতা, ডাগর, গুরা বা গুরাল, নোনা ঝাউ, পুইন্যাল, সিংড়া, কালি লতা, আরালি, খুলশী, তুনশা, করঞ্চাসহ প্রভৃতি।
বনের হাজার হাজার মণ শুকনা কাঠ, পাতা সংগ্রহ করে জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করছে উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণ। সুন্দর বনের গোল পাতা আরও একটি আয়ের উৎস। সুন্দরবন একদিকে যেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক আয়ের উৎস অন্য দিকে সরকারি রাজস্ব আয়ের ও উৎস। চিরসবুজের এই সুন্দর বন সৌন্দর্য, রূপ মাধুর্যে যেন অনন্ত যৌবনা। এত সৌন্দর্যমণ্ডিত সুন্দরবন ভ্রমণপিপাসু মানুষ তথা বিনোদন পিপাসুদের অতীত থেকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
সে ডাকে সাড়া দিয়ে সুন্দরবন সম্পর্কে জানতে, চিনতে এর অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে দেশি, বিদেশি পর্যটক সবসময়ই আসছে। সুন্দরবনের আশপাশের বসতি এলাকায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উদ্যোগে গোলপাতাসহ নানা ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বৃক্ষরোপণ করা হচ্ছে, যা সেখানকার বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা বৃদ্ধি করছে ও স্থানীয়দের আয় বাড়াচ্ছে। উপকূলে নতুন জেগে ওঠা চরসহ ফাঁকা জমিতে গাছ লাগানোর বিষয়টি বন বিভাগ দেশে জনপ্রিয় করে তুলেছে। এ ছাড়া গ্রামের মানুষ গাছকে তার ‘সামাজিক বিমা’ হিসেবে দেখে। মূলত গাছের বিক্রয়মূল্যের জন্য গাছ লাগানোতে মানুষ উৎসাহিত হচ্ছে। এতে সামগ্রিকভাবে পরিবেশের জন্য ভালো হচ্ছে।
সুন্দরবনের বৃক্ষ বিস্ময়ের ফলে তিন কোটি টন কার্বন বেড়েছে। কোনো একটি বনে বৃক্ষ সম্পদের অবস্থা বোঝার জন্য বিশ্বজুড়ে নতুন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। তা হচ্ছে ওই বনের বৃক্ষ সম্পদের মধ্যে কী পরিমাণ কার্বন মজুত আছে। বাংলাদেশে একমাত্র সুন্দরবনের কার্বনের মজুত নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়েছিল ২০০৯ সালে। ওই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, সুন্দরবনে কার্বন মজুতের পরিমাণ ১০ কোটি ৬০ লাখ টন। ২০১৯ সালের নতুন এই সমীক্ষায় কার্বন মজুতের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ কোটি ৬০ লাখ টনে। এখন পর্যন্ত আমাদের যে কটি বন আছে, তার মধ্যে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম। কারণ বৃক্ষ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও সুন্দরবনের বৃক্ষ সম্পদ বেড়েছে।
এটি এই বনের প্রাকৃতিক শক্তিমত্তার পরিচয়। তবে এর চারপাশে শিল্পকারখানা, পর্যটন কেন্দ্রের নামে অবকাঠামোর যে চাপ বাড়ছে, তাতে দীর্ঘ মেয়াদে এই বনের প্রাকৃতিক সম্পদকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। তাই সরকারের উচিত সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের তৎপরতা বন্ধে কঠোর হওয়া।