সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ও বিখ্যাত কাঁসা-পিতল শিল্প। আগে কাঁসা-পিতল সামগ্রী গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্য ব্যবহৃত ও সামগ্রী হিসেবে দেখা যেত। বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়া লাগার সঙ্গে সঙ্গে এসবের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে।
ঢাকা জেলার বৃহত্তম উপজেলা ধামরাই এলাকা কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। ওই সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল এর প্রচুর চাহিদা। এছাড়া বিদেশি পর্যটকরা একসময়ে কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজ খচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেত। কিন্তু এই কাঁসা-পিতল শিল্পের ঐতিহ্য আজ নানা সমস্যার কারণে দিনে দিনে হারিয়ে যেতে বসেছে। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পের সাথে জড়িত শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা আজ অভাব অনটনে দিন কাটাচ্ছে। তাদের দেখার ও কেউ নেই। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে আজ কাঁসা-পিতল শিল্পে জড়িতরা বিভিন্ন পেশায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। এই কারুশিল্পী ও ব্যবসায়ীদের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কখনোই কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কেউ।
এ ব্যাপারে সরেজমিনে কথা হয় ধামরাই মেটাল ক্রাপ্টস এর স্বত্বাধিকারী সুকান্ত বণিকের সঙ্গে। প্রায় দেড়/দুইশ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষরা এ পেশার সঙ্গে জড়িত। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ধামরাই উপজেলা সদরেই নোটা, ঘটি, হাড়ি-পাতিল, থালা, গ্লাস, বদনি ও বিভিন্ন শো-পিচ, দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্র তৈরির জন্য স্বাধীনতার পূর্বেও প্রায় ৩০/৪০টি কারখানা ছিল। বর্তমানে এ কারখানা সংখ্যা ৪/৫টি মতো। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে প্লাস্টিক, লোহা ও স্টিলের তৈরি এসব জিনিসপত্র তৈরি হওয়ায় কাঁসা-পিতল কেনায় বেশ ভাটা পড়েছে।
সুকান্ত বণিক বলেন, কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্র একবার কিনলে তা ২০/৩০ বছরের বেশি সময় ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয়, যে দামে কেনা হতো ব্যবহারের পর তার চেয়েও বেশি দামে বিক্রি করা যেত।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগে এসব জিনিসপত্র রপ্তানির ক্ষেত্রে তেমন একটা বেগ পেতে হতো না। বর্তমানে রপ্তানি করতে গেলে নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়।
এই শিল্পের শ্রমিকদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার এখানে সারাদিন কাজ করে একজন শ্রমিক যা পায় তার চেয়ে বাইরে কাজ করলে বেশি উপার্জন করতে পারে। তাই দিন দিন শ্রমিকের সংখ্যাও কমে গেছে।
ধামরাই মেটাল ক্রাপ্টসে কর্মরত নিমাই পাল (৪৫) নামের এক শ্রমিক। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আগে বাপ-দাদার সাথে প্রতিমা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে কাঁসা-পিতলের তৈরির সঙ্গে তিনি এখানে ২৩ বছর ধরে কর্মরত আছেন। তিনি প্রতিমা ও বিভিন্ন দেবদেবীর এবং জীবজন্তুর প্রতিকৃতির কর্মকার। এখানে তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন।
আরও কথা হয় ৫০ বছর বয়সী কাঁসা পিতলের ব্যবসায়ী আনিসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, তার বাপ-দাদার পেশা ধরেই ২৮ বছর যাবৎ ধামরাই বাজারে ব্যবসা করে আসছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরেও এ ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। এ বাজারেই ছিল অনেক ব্যবসায়ী। বর্তমানে আছে হাতেগোনা কয়েকজন।
এই ব্যবসায়ী বলেন, বর্তমানে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের মেয়ের বিয়েতে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের তৈরি কিছু জিনিসপত্র কেনা হয়। তাছাড়া সচরাচর কেউ এসব কিনে না। তাই ব্যবসায় পড়েছে ভাটা।
শিল্পকর্ম ব্যবসায়ী অরুণ বণিক জানান, আমরা কাঁসা-পিতলের থালার মধ্যে নকশা করে বিক্রি করলে ২৫০০/২০০০ টাকা দাম পাওয়া যায়। এতে লাভ থাকে মোটে ২০০/৩০০ টাকা।
এক সময়ে এই কাঁসা-পিতল শিল্প খুব বিখ্যাত ছিল বলে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ধরনের শিল্পর্কম নকশা করে বিদেশে রপ্তানি করতেন। তাদের তৈরি থালা, কলসি, বাটি, ঘটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্রসহ অন্যান্য জিনিসের চাহিদা এখনো অনেকাংশে কমে গেছে। এসব জিনিসের দাম বৃদ্ধির কারণ হলো- প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাব, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিল্পী ব্যবসায়ীরা ধীরে ধীরে তাদের পেশার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে পড়েছে। কাঁচামাল আমদানিকৃত বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়েছে গত ১৪/১৫ বছরে প্রায় তিনি গুণ। অপর দিকে স্টিলের জিনিসের থালা, বাটি, চামচ, গ্লাসসহ বিভিন্ন জিনিসের আর্ধিক্যের কারণে দেশীয় কাঁসা পিতল শিল্পের জিনিসের চাহিদা যথেষ্ট কমে গেছে।