সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সুন্দরবনের শান্ত নদী শাকবাড়িয়া। নদীর এক পাশে নয়নাভিরাম সুন্দরবন, অন্য পাশে খুলনার কয়রা উপজেলার পাথরখালী গ্রাম। নদীতীরে গ্রামটির চরজুড়ে সারি সারি কেওড়াগাছের সমাহার। সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা কেওড়া ফল চরে আটকে প্রকৃতির অবারিত দানে বেড়ে উঠেছে গাছগুলো। সুন্দরবনের কোলঘেঁষা এ বনে বাঘ-হরিণ নেই। তবে এটি গত চার বছরে যেন হাজারো পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। বক, শামুকখোল, পানকৌড়িসহ হরেক রকমের পাখির কলরবে মুখর থাকে পুরো কেওড়াবন।
প্রতিদিন বিকেল থেকেই কেওড়াগাছগুলোতে পাখিরা আশ্রয় নিতে শুরু করে। পশ্চিমের আকাশে গোল সূর্যটা লাল হয়ে সন্ধ্যা নামার আগেই পাখিদের দখলে চলে যায় গাছের শাখা-প্রশাখাগুলো। সাদা বক বসে থাকা গাছগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, গাছের মধ্যে সাদা সাদা ফুল ফুটে আছে। কাছে-দূরের অনেক মানুষ এসব পাখি দেখতে ভিড় করেন পাথরখালী গ্রামের নদীতীরে। দল বেঁধে পাখিদের ওড়াউড়ির দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন দর্শনার্থীরা।
কয়রার সুন্দরবনসংলগ্ন পাথরখালী গ্রামের বাসিন্দা ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য রেজাউল করিম বলেন, চার বছর ধরে প্রতিদিন সন্ধ্যার আগে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এসে রাত যাপন করে নদীর চরের কেওড়াবনে। সকাল হলেই আবার ঝাঁকে ঝাঁকে খাদ্যের সন্ধানে অন্যত্র চলে যায়। এখন ধীরে ধীরে পাখির সংখ্যা বাড়ছে। মানুষ এখানে পাখি দেখতে আসেন। এলাকার মানুষও পাখিদের বিরক্ত করে না। পাখিরা এখানে খুব নিরাপদে আছে। এই এলাকা পাখির অভয়ারণ্য বলা চলে।
গতকাল বিকেলে পাথরখালী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, শাকবাড়িয়া নদীর তীরে শত শত কেওড়াগাছ। চরের নরম মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠেছে গাছের শ্বাসমূল। নদীর ওপারের সুন্দরবনে সুনসান নীরবতা আর এপারের কেওড়াবনে হাজারো পাখির কিচিরমিচির রীতিমতো চারপাশ উচ্ছল করে তুলেছে। পানকৌড়ি, সাদা বক, শালিক, দোয়েল, ঘুঘুসহ নানা প্রজাতির পাখি কেওড়াগাছে বসে ডানা ঝাপটাচ্ছে, উড়ে গিয়ে দু-এক চক্কর দিয়ে আবার এসে বসছে। কোনোটা গাছের এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে গিয়ে বসছে। পাখিদের বাসা থেকে ছানাগুলো ডাকছে। তাদের খাওয়াতে ব্যস্ত মা পাখিরা। কেওড়াবনজুড়ে তৈরি হয়েছে প্রাণ-প্রকৃতির বুনো মেজাজ।
কেওড়াবনের পাশে শাকবাড়িয়া নদীর চরে মাটি ফেলে উঁচু করে ঘরবাড়ি তৈরি করে বসবাস করছেন কয়েকজন। সেখানকার একটি বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলেন গৃহিণী লক্ষ্মী রানী মণ্ডল। মুগ্ধ চোখে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখছিলেন তিনি। প্রতিদিন ভোরে পাখিদের কিচিরমিচিরে বাড়ির লোকজনের ঘুম ভাঙে আর পাখি দেখেই তাঁর বিকেল কাটে বলে জানান তিনি।
লক্ষ্মী রানী বললেন, ‘এই যে কিচিরমিচির শুনছেন, এইটা অন্ধকার হওয়া পর্যন্ত চলতি থাকে। অনেক রাইত হলি বেশির ভাগ পাখি চুপ হইয়ে যায়। এইখানে সাদা বকের সংখ্যাই বেশি। তবে কানি বক, পানকৌড়ি আর শামুকখোলও আছে। মাঝেমধ্যে নাম না-জানা নানা পাখি বেড়াতি আসে। সাদা বকের ভিড়ে অন্য পাখি আলাদা করা কঠিন।’
পাখি দেখতে আসা কয়েকজন দর্শনার্থীর সঙ্গে দেখা হয় পাথরখালী গ্রামের বেড়িবাঁধের ওপর। তাঁদের মধ্যে আল-আমীন নামের একজন বলেন, ‘কেওড়াগাছের ডালে পাখি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। অনেকগুলো ছবি তুলেছি আজ। সত্যিই এমন দৃশ্য অপূর্ব লাগে।’
বন বিভাগের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘ওই এলাকা আমাদের টহল ফাঁড়ির কাছাকাছি। পাখিরা চরের ওই কেওড়াবনকে নিরাপদ মনে করে, তাই সেখানে আশ্রয় নেয়। বিকেলে পাখির ডাক ও ওড়াউড়িতে ভিন্ন এক পরিবেশ তৈরি হয় সেখানে। পাখিগুলোকে কেউ বিরক্ত করে না। পাখিদের বিচরণ যাতে কোনোভাবে ব্যাহত না হয়, সেটি আমরা দেখছি।’